এই ভারতের মহামানবের…

এই ভারতের মহামানবের…

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে বৃত্তি পেলেন আমার মা। পণ্ডিতমশাই মায়ের ‘রানি’ নামের আগে ‘বিদ্যা’ বসিয়ে নামকরণ করে দিলেন বিদ্যারানি। ব্রাহ্মণ পরিবারের গৃহবধূ, সকাল সন্ধ্যা ঠাকুরঘরে কাটানো আমার মা, উনুনপাড়ে একহাতে খুন্তি, অন্য হাতে শরৎ বা বিভূতি নিয়ে বললেন, দেখো বাবা, আমি কি বুঝি না, পাঁঠা খেলে দোষ নেই, আর গরু খেলে দোষ? তবু, কী করব বাবা, সবই সংস্কার।’’ মায়ের অন্তরের এই সংস্কারমুক্তিই বোধহয়, পরবর্তী জীবনে আমাকে গরু, শুয়োর, পাঁঠা খেতে শেখাল।
সেই কোন বয়সে, বাবার কেনা, কিন্তু অপঠিত, বাংলা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ হাতে পেয়ে বুঝলাম, কেষ্ট লীলা কাকে বলে। এটাও বুঝলাম, হিন্দু ধর্মের একটা সহজ জীবনধর্মী ভাব আছে। বুঝলাম, কৃষ্ণ থেকে চৈতন্য, রামকৃষ্ণ থেকে কবীর সকলেই ভালবাসার বাঁধনে মানুষকে প্রেমিক হতে শিখিয়েছেন। ফলে, প্রেমিক হতে শিখলাম, কিন্তু ধার্মিক হতে শিখলাম না। তাই নিয়েই কেটে গেল এতটা কাল। এতদিনে সে ভুল ভাঙল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরশ্রেষ্ঠ মোদিজী আসার পর বুঝলাম, যা শিখেছিলাম, সব ভুল ছিল। ঘৃণায় জারিত হলে তবেই না ধর্ম। আমাদের নতুন সঙ্কল্প, আমরা এবার হিন্দু-মুসলিম সম্মুখ সমরে নামব। সারা বিশ্বকে দেখাতে হবে, আর যাই হোক আমরা ভীরু নই। আমরা রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃহত্যায় পিছপা হই না। সেখানেই তো সাফল্য। আমরা এখন বড় মুখ করে বলতে পারছি, আমরা বাঙালী, নহিকো মেষ। আমাদের রক্তে এখন সিংহের শক্তি, বাহুতে আমাদের অপরিমেয় পেশিশক্তি। বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি, আমাদের অন্তরে শ্রী চৈতন্যের, রামকৃষ্ণের, কবীরের ভালবাসা নেই। আমাদের অন্তর এখন ঘৃণায় জারিত।
এই ঘৃণার শক্তির চরম প্রকাশ ঘটেছে বন্ধুর হাত ধরে, এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কিছু আছে কি? প্রযুক্তির কল্যাণে, অসংখ্য বন্ধু এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। এবং সেই বন্ধুদের হাত ধরেই অনায়াসে ঢুকে পড়েছি ঘৃণার আবর্তে। যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত বলতে থাকে, ওই তো তোমার শত্রু, ওকে নিধন কর, তারাই তো প্রকৃত বন্ধু, তারাই তো ফেসবুক, টুইটার আর সোস্যাল মিডিয়া। তারাই তো আমাদের স্বপ্নের ডিজিটাল ইন্ডিয়া।
ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জিএসটি করেছেন, নোটবন্দি করেছেন, আঙুল টিপে শিখিয়েছেন কীভাবে পেটিএম করতে হবে। আর এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার দৌলতে আজ মোদি এবং বিজেপি ভক্তরা এখন ফেসবুক, টুইটার, লিংকডিনের সর্বত্র হাতের কারসাজি দেখিয়ে চলেছেন। এবং স্বভাবতই ধর্মের আগুন উস্কেছে। যে জঙ্গীরা এতকাল আফগানিস্তানে কতলের ছবি দেখিয়ে এসেছে, আমরা ঘৃণার সঙ্গে বলে এসেছি, ছিঃ কি অসভ্যতা! এবার আমরা কেমন দেখাতে পারছি, দেখ, আমরা অসভ্যতর হতে পারি।

হিন্দু ধর্মের ধারক-বাহকেরা পরিতৃপ্তির উদগার তুলে গর্বিত স্বরে বলতে পারছেন, কেমন দিলাম? আর আমরা বিনয়াবনত হয়ে জানাচ্ছি, অধমদের যা গেলাচ্ছেন তা গিলেই আমরা পরম খুশি। কত কি শিখছি নতুন করে। বিজেপি-র যুবা- প্রবীণদের কাছ থেকে শিখছি, কুতব মিনার আসলে নাকি হিন্দু মিনার, শিখছি, তাজমহলের অন্দরে বহু তালাবন্দি কক্ষে নাকি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে, জানতে পারছি, গোরক্ষক হতে পারলেই নাকি তার লাঙুল ধরে আপনি বৈতরণী পার করতে পারবেন, জানতে পারছি, নেহরু আর জিন্না নাকি একই বংশজাত সন্তান। জানতে পারছি, প্রধানমন্ত্রীর জীবনের প্রত্যুষ লগ্নের সেই চায়ের দোকানের টানে আজ সেখানে পর্যটকেদের ভিড়।

এ রাজ্যের প্রাচীন শহর রানিগঞ্জ স্টেশনে এক চায়ের দোকানে কৈশোর কেটেছিল এক সঙ্গীতকারের। এখন শিখেছি, ছাতির মাপে নজরুলকে অনেক ছাড়িয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। আরও কত কী যে শিখছি, তার ইয়ত্তা নেই। এখনই তো পথে নামার সময়।
এখনই তো, আমাদের সকলের সোচ্চারে গলা মেলাবার কথা- আর দেরী নয়, ধর গো তোরা, হাতে হাতে ধর গো।
কিন্তু তবু কেন যে, চোখের কোণে পানি আসে। কেন যে, পশ্চিম দিগন্তে সূর্য পাটে গেলে, সামনের দরজায় আগল টেনে, নীরবে চোখের জল ফেলে গুনগুন করতে ইচ্ছে হয়-
আজি এ ভারত লজ্জিত হে,
হীনতাপঙ্কে মজ্জিত হে
নাহি পৌরুষ, নাহি বিচারণা,
কঠিন তপস্যা, সত্যসাধনা-
অন্তরে বাহিরে ধর্মে কর্মে
সকলই ব্রহ্মবিবর্জিত হে।

Leave a comment